আসুক শীত ত্বক প্রস্তুত

জানালার ধারে এসে, কাঁপে প্রজাপতি…
এমন শীত এখনো আসেনি। তবে আসতে আর কতক্ষণ। ভোরের শিশির কুয়াশা দেখা যাচ্ছে। কম্বল নামানোও শুরু হয় গেছে। শীতের কাপড়গুলো বের করে ধুলা-ময়লা ঝাড়াও হচ্ছে। প্রকৃতিতে শীতের আয়োজন যে শুরু হয়ে গেছে, তা বোঝা যায় ত্বকের দিকে তাকালেই। ত্বকে টান টান ভাব আর শুষ্কতা জানান দিচ্ছে বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার সময় এসে গেছে। শীতেও ধরে রাখা যেতে পারে ত্বকের প্রাকৃতিক জৌলুশ। তবে ধরন অনুযায়ী পাল্টে যাবে পরিচর্যার প্রক্রিয়া।

তৈলাক্ত ত্বকে

অতিরিক্ত তেলতেলে ভাব, বন্ধ হয়ে যাওয়া লোমকূপ, ব্রণ—তৈলাক্ত ত্বকের লক্ষণ। যদিও শীতে ত্বকের তৈলাক্ত ভাবটা কমে যায়, কিন্তু বিশেষ নজরে রাখা চাই বছরের অন্য সময়ের মতোই। সকালে কোমল ক্লিনজিং জেল দিয়ে ত্বক পরিষ্কারের পাশাপাশি টোনার ব্যবহার জরুরি। এ ক্ষেত্রে স্যালিসাইলিক অ্যাসিডযুক্ত টোনার বন্ধ লোমকূপ খুলে দিতে সাহায্য করে। তারপর টি ট্রি তেল, গ্রিন টির মতো অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আছে এমন সেরাম (ত্বক পরিচর্যার তরল) ব্যবহার করুন। জিংক অক্সাইডযুক্ত সানস্ক্রিন তৈলাক্ত ত্বকের জন্য উপযোগী। রাতে এএইচএ কিংবা বিএইচএযুক্ত সেরাম ছাড়াও রেনিটেলযুক্ত সেরাম তৈলাক্ত ত্বকের জন্য সেরা। মধু, লেবুর রস আর বেকিং সোডার মিশ্রণে তৈরি ফেস স্ক্রাব দিয়ে এক্সফোলিয়েশন (মুখের মরা চামড়া তুলে নেওয়া) করা যেতে পারে। পরিষ্কার করবে, আর্দ্রতাও ধরে রাখবে। দুই চা-চামচ ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা জেলের সঙ্গে এক চা-চামচ দই, টমেটোর ভেতরের নরম অংশ এক চা-চামচ মিশিয়ে তৈরি করা যায় প্যাক। লেমন কিংবা জোজোবা ফেস অয়েল ব্যবহার করুন এ সময়। এ ছাড়া সপ্তাহে একদিন ক্লে কিংবা মাড মাস্ক ত্বকের সুস্থতা বজায় রাখবে। তৈলাক্ত ত্বকের জন্য হায়ালুরনিক অ্যাসিড, বেনজোয়েল পার অক্সাইডযুক্ত প্রসাধন–সামগ্রী বেছে নিন।
হাত-পায়ের জন্য দরকার নিয়মিত ময়েশ্চারাইজিং

শুষ্ক ত্বকে
ক্লিনজিং লোশন কিংবা ক্রিমি ক্লেনজার শুষ্ক ত্বকের জন্য উপযোগী। সঙ্গে ওমেগা ফ্যাটি অ্যাসিড কিংবা সিউইড, গোজি বেরির মতো অ্যান্টি অক্সিডেন্টযুক্ত মিল্কি টোনার শুষ্ক ত্বকে আর্দ্রতা জোগাবে, রাখবে মসৃণ। অ্যান্টি অক্সিডেন্টযুক্ত সেরাম বাড়তি পুষ্টি জোগাবে। এসপিএফযুক্ত ভারী ময়েশ্চারাইজার শুষ্ক ত্বকের সুরক্ষার জন্য সেরা। রাতে হায়ালুরনিক অ্যাসিডযুক্ত সেরাম দেবে বাড়তি আর্দ্রতা। রেনিটেলযুক্ত সেরাম আর আই ক্রিমও শুষ্ক ত্বকের জন্য উপকারী। আলট্রা হাইড্রেটিং আরগন কিংবা ল্যাভেন্ডার ফেস অয়েল শুষ্কতা দূর করবে, পুষ্টি জোগাবে ভেতর পর্যন্ত।

এ ছাড়া অ্যাভোকাডো, মধু আর ডিমের সাদা অংশ মিশিয়ে তৈরি প্যাক শুষ্ক ত্বককে আর্দ্র রাখবে। অ্যালোভেরা জেলের সঙ্গে জলপাই তেল আর মধু মিশিয়ে সেই প্যাকও ব্যবহার করা যায়। এএইচএ ফেইস পিল ব্যবহার করতে পারেন সপ্তাহে একদিন। সে ক্ষেত্রে সমপরিমাণ আখের রস আর দই দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। মুখে মেখে রাখুন ২০ মিনিট। ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে নিন। নিয়ম মেনে চললে শীতেও সুস্থ থাকবে শুষ্ক ত্বক।

স্বাভাবিক ত্বকে
এ ধরনের ত্বকে বেশি আলাদা যত্নের প্রয়োজন পড়ে না। বরং সাধারণ রুটিনের সঙ্গে কিছু বাড়তি জিনিস যুক্ত করলেই চলবে। এ সময় হায়ালুরনিক অ্যাসিডযুক্ত ময়েশ্চারাইজার আর্দ্রতা ধরে রাখবে ভালোভাবে। রাতের ক্রিম হিসেবে ভিটামিন বি থ্রি, সি এবং ই আছে এমন ক্রিম শীতের জন্য ভালো। গ্লাইকোলিক অ্যাসিডযুক্ত ফেইস সেরামও স্বাভাবিক ত্বককে সুস্থ রাখবে শীতে। দেবে বাড়তি জেল্লা। অ্যাভোকাডো, অ্যালোভেরা, কলা, ওটমিল, ডিমের কুসুম, মধু ইত্যাদি দিয়ে তৈরি ফেসপ্যাক ব্যবহার করুন।

মিশ্র ত্বকে
এ ধরনের ত্বক পরিষ্কার করতে বিশেষ ধরনের প্রসাধন–সামগ্রী ব্যবহার করা চাই। টি জোনকে (কপাল থেকে নাকের দুই পাশ) পরিষ্কার রাখবে। সঙ্গে ত্বকের শুষ্ক অংশগুলোকেও আর্দ্র রাখবে। সে ক্ষেত্রে ত্বক ভারসাম্যকারী ক্লিনজার আর টোনার বেছে নিতে হবে। ময়েশ্চারাইজারও বাছতে হবে সাবধানে। এটি হতে হবে ভেজা কিন্তু তেলহীন। ফলের এনজাইমে তৈরি এক্সফোলিয়েটর মিশ্র ত্বকের জন্য বেশি উপকারী। রেনিটেল ছাড়াও এএইচএ আর বিএইচএতে তৈরি সেরাম এ ধরনের ত্বকে ব্যবহার করা যায় অনায়াসেই। ত্বকের জন্য তেল ব্যবহার করতে চাইলে আঙুরের বিচি, জলপাই, অ্যালোভেরা ছাড়াও গাজরের বিচির তেল থেকে বেছে নেওয়া যেতে পারে যেকোনোটা। ত্বকের ধরন বুঝে মাল্টি মাস্কিং প্রক্রিয়ায় সপ্তাহে একদিন মিশ্র ত্বকের বিশেষ যত্ন নিন ঘরে বসেই।

ত্বক ভালো রাখার টিপস
* ত্বক ও চুলের সুস্থতা বজায় রাখতে শীতকালীন সবজি চমৎকার। কমলা, আপেল ও বেরির মতো ফল ত্বকের উজ্জ্বলতা ধরে রাখবে শীতজুড়ে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের বাদাম, কুমড়ার বিচি, স্ট্রবেরি, অ্যাভোকাডো, নারকেল রাখা দরকার শীতের খাবারের তালিকায়।
* সপ্তাহে একদিন স্পা করতে পারেন ঘরে বসেই। এতে শীতের রুক্ষতা থেকে রক্ষা পাবে পুরো শরীর। দুই কাপ চিনির সঙ্গে অর্ধেক কাপ এসেনশিয়াল অয়েল মিশিয়ে পুরো শরীর স্ক্রাব করে নিন। মুখের ত্বকের জন্য ওটমিল আর মধুর মিশ্রণ উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে দিতে দারুণ। যাঁরা ত্বক মসৃণ করতে চান, তাঁরা কুমড়ার ভেতরের নরম অংশের সঙ্গে মধু আর দুধ মিশিয়ে তৈরি করে নিন প্যাক।
* তৈলাক্ত ত্বকের যত্নে বেছে নিতে পারেন লেবু কিংবা জোজোবা তেল। এগুলো ত্বকের দাগ-ছোপ দূর করবে, রোধ করবে ব্রণ। ত্বকের সেরাম উৎপাদনের মাত্রাকে রাখবে স্বাভাবিক। জোগাবে আর্দ্রতাও। শুষ্ক ত্বকের জন্য ল্যাভেন্ডার আর আরগান তেলটাই বেশি উপযোগী। এগুলো ত্বকের গভীরে আর্দ্রতার জোগান দেয়, দূর করে দাগ-ছোপ। আলট্রা হাইড্রেটিং হওয়ায় ত্বককে সহজে বুড়িয়েও যেতে দেয় না। স্পর্শকাতর ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন শণবীজ কিংবা পেপারমিন্ট তেল। ত্বক ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করবে তেলগুলো। র‌্যাশ আর লালচে ভাব সারাবে।
* ত্বক পরিষ্কারের জন্য ডবল ক্লেনজিং এখন জনপ্রিয়। এতে মূলত দুই ধরনের ক্লিনজার ব্যবহার করা হয়। একটা তেলযুক্ত ক্লিনজার, যা মেকআপ আর সেরামের মতো তৈলাক্ত ময়লাগুলো দূর করে। তারপর ব্যবহার করা হয় ফোম অথবা ক্রিম ক্লিনজার। ঘাম ও ধুলাবালুর মতো পানিযুক্ত ময়লা দূর করতে সাহায্য করে। ফলে ত্বক হয় পরিপূর্ণ পরিষ্কার।
* শীতে সূর্যটা খুব বেশি প্রখর না থাকলেও সূর্যের ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মি এই সময়েও সমান ক্ষতিকর। প্রতিদিন সানস্ক্রিন ব্যবহার করা চাই। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি এসপিএফ-যুক্ত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা যায়। শীতে ত্বক আর্দ্রও থাকবে, থাকবে সুরক্ষিত।
* খুব বেশি লম্বা সময় ধরে গোসল করা উচিত নয়। এতে ত্বকের প্রাকৃতিক তেল নষ্ট হয়ে যায়। এতে ত্বক দেখায় ম্যাড়মেড়ে, রুক্ষ ও খসখসে। তাই শীতে অল্প সময়ে ঈষদুষ্ণ পানিতে গোসলটা সেরে নিন। গোসলের পরপরই ভারী ময়েশ্চারাইজার মেখে নিন ত্বকে।
* শীতে গোল্ডেন মিল্ক খেয়ে দেখতে পারেন। এটা বানানো খুব সহজ। এক কাপ দুধে অর্ধেক চা-চামচ হলুদ পেস্ট কিংবা গুঁড়া, ১ টেবিল চামচ নারিকেল তেল, সিকি চা-চামচ গোলমরিচের গুঁড়া আর দুই স্টিক দারুচিনি দিয়ে ফুটিয়ে নিন। তারপর ছেঁকে খেয়ে নিন। ত্বক উজ্জ্বল করবে এটি। চুলের বৃদ্ধিও ত্বরান্বিত করবে। অ্যান্টি এজিং হিসেবেও দারুণ। সঙ্গে ঠান্ডাজনিত যেকোনো সমস্যা সারাবে।
* যোগব্যায়াম দেহের রক্ত সঞ্চালনকে ত্বরান্বিত করে। ফলে দেহ পায় বাড়তি অক্সিজেন আর উপকারী ফ্রি র‌্যাডিকেল, যার প্রভাব পড়ে ত্বকেও। হয়ে ওঠে তারুণ্য আর উজ্জ্বল।

প্রতিদিনকার পরিচর্যায়
দিনে ও রাতে দুই বেলা নিয়ম করে ক্লেনজিং টোনিং—ময়েশ্চারাইজিং করতে হবে ত্বকে। সানস্ক্রিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক। মুখে দাগ-ছোপের জন্য স্পষ্ট ট্রিটমেন্ট ক্রিমটাও প্রতিদিন ব্যবহার করতে হবে নিয়ম করে। প্রতিদিন গোসলটা করতেই হবে। এতে ক্লান্তি দূর হবে, শরীর থাকবে ঝরঝরে। প্রতিদিন আট ঘণ্টা ঘুমান ঘড়ি ধরে। পর্যাপ্ত পানি পান করুন। চাইলে ‘ইনফিউজড ওয়াটার’ পান করতে পারেন। স্বাদের পাশাপাশি পুষ্টিগুণও বাড়বে পানির। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে লেবুপানি পান করতে পারেন। সকালে নাশতায় স্মুদি তৈরি করুন। ভিটামিন এ, সি, ই আর কে-তে পরিপূর্ণ এ পানীয়গুলো দেহের প্রয়োজন মেটানোর সঙ্গে ত্বককেও রাখবে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল। প্রতিদিন খাবারে পালঙের মতো সবুজ শাকের সঙ্গে অ্যাভোকাডো আর কলাও রাখতে পারেন মেন্যুতে। নিয়ম করে প্রতিদিন খেতে পারেন ত্বক, চুল আর নখের সাপ্লিমেন্ট।

ত্বক পরিষ্কারের পাশাপাশি টোনার ব্যবহার করুনসপ্তাহান্তে
কর্মজীবী নারীরা ছুটির দিনে ত্বককে দিন বিশেষ যত্ন। ঘরে বসে ত্বকের ধরন অনুযায়ী ফেস মাস্ক তৈরি করে মেখে নিন মুখে। সঙ্গে ত্বককে দিন রিল্যাক্সিং ফেসিয়াল ম্যাসাজ। শিট মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন সপ্তাহে একবার। মাথার ত্বকও মালিশ করে নিন। সঙ্গে চুলকে দিন ডিপ কন্ডিশনিং ট্রিটমেন্ট।
নখের যত্ন নিন। নখ কাটার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিম লাগান। নেইলপলিশ তুলে ফেলুন কিংবা রংটা পাল্টাতে পারেন। পুরো বডি স্ক্রাব করে নিতে হবে সপ্তাহে একবার। ছুটির দিনে হালকা ইয়োগা করতে পারেন। সঙ্গে সপ্তাহে একদিন যন্ত্রের সহায়তায় ব্যায়াম করা ত্বকের জন্য উপকারী। এ ছাড়া বালিশের ঢাকনা পরিবর্তন আর মোবাইলের পর্দা জীবাণুমুক্তকরণ করতে হবে সপ্তাহে। মেকআপের ব্রাশও পরিষ্কার করে ফেলতে হবে এ সময়।

পাক্ষিক পরিচর্যা
পনেরো দিনে একবার হলেও ভ্রুর পরিচর্যা করতে হবে। থ্রেডিং বা ওয়্যাক্সিং (লোম তোলা) করে নিতে হবে পছন্দ অনুসারে। হাত-পায়ের অবাঞ্ছিত লোমও তুলে ফেলা দরকার। হাত-পায়ের যত্নে ম্যানিকিউর-পেডিকিউর আবশ্যক। চুলের যত্নে নিতে পারেন হট অয়েল ট্রিটমেন্ট (তেল একটু গরম করে মালিশ করা)। চুলের ফাটা আগাও ছেঁটে নেওয়া যেতে পারে এ সময়।
শীত আসবেই। ত্বকের ওপর শীতের প্রভাব পড়বেই। তাই বলে কি শীতের কাছে হেরে যাবেন? মোটেই না। যত্ন নিন এখন থেকেই। ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। সুন্দর থাকুন।

লেখাটিতে বেশ কিছু কারিগরি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে প্রসাধনীর নাম, ধরন, উপকরণ এবং ত্বক পরিচর্যার পদ্ধতি বোঝার জন্য।

0 replies

Leave a Reply

Want to join the discussion?
Feel free to contribute!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *